সন্দ্বীপের জাহাজ শিল্পের ইতিহাস
পুরনো সাহিত্যের ধূসর পাতা থেকে জানা যায় আমাদের জাহাজের নামগুলো। মধুকর, ময়ূরপঙ্খী, রাজহংস, রত্নপতি, শঙ্খচূড়, সমুদ্রফেন, উদয়তারা, কাজলরেখা, গুয়ারেখী, টিয়াঠুটি, বিজুসিজু ভাড়ার পটুয়া ইত্যাদি। এদের মধ্যে গুয়ারেখী, টিয়াঠুটি, বিজুসিজু, ভাড়ার পটুয়া নামগুলো প্রাকৃত শব্দ। আমাদের নৌশিল্পের আরো প্রাচীন যুগের সাক্ষী এসব শব্দ। লোকসাহিত্যের তথ্য নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের বইয়ের ও তাম্রলিপির তথ্য তাদের সন্দেহ মুছে দেবে। বৌদ্ধদের প্রাচীনতম বই ‘মিলিন্দ পান হো’। প্রথম খ্রিস্টাব্দে লেখা বইটিতে নৌ চলাচলের জন্য প্রসিদ্ধ কয়েকটি দেশের নাম আছে। সে তালিকায় আছে সন্দ্বীপের নাম আর সন্দ্বীপের জাহাজের কথা। পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী’। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ষাট খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি বই। বইটিতে আছে আমাদের জাহাজের কথা। আমদের প্রাচীন ‘গাঙ্গে’ বন্দর থেকে ‘কোলান্দিয়া’ জাহাজ যেতো আরব, চীন, জাপান, জাভা, সুমাত্রা আর শ্রীলংকার বন্দরে। জাভাতে বরোবুদুর নামে একটি প্রাচীন মন্দির আছে। সেই মন্দিরের গায়ে আঁকা আছে আমাদের জাহাজের ছবি। ষোল শতকের আরেক বিখ্যাত পর্যটক সিজার দি ফ্রেডারিক। তার মতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র ছিল আমদের সন্দ্বীপ। সারা দুনিয়ায় ছিল সন্দ্বীপের জাহাজের নাম ডাক। তুরস্কের সুলতান তখন দুনিয়ার নেতা। তিনিও জেনেছিলেন সন্দ্বীপের জাহাজের খ্যাতি। সন্দীপ থেকে অনেক জাহাজ তৈরি করে নেন সুলতান। এর আগে তুর্কীরা জাহাজ সংগ্রহ করতো মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে। সেখানকার জাহাজ সুলতানকে সন্তুষ্ট করতে না পারলেও বাংলাদেশের সন্দ্বীপের জাহাজ সুলাতানকে মুগ্ধ করে। ফারসী ভাষার ইতিহাসবিদ শাহাবুদ্দিন তালিশ। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে মোঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ, মীর জুমলা, শায়েস্তা খাঁর আমলের নৌ বহরের কথা। সে সময় ঢাকার নৌবহরে তিন হাজার জাহাজ ছিল। সবচেয়ে বড় জাহাজের নাম ছিল সলব। তারপর ঘ্রাব, জলবা, কোশ, খালু, ধুম। এসব রণতরী জলদস্যু দমনে ব্যবহৃত হতো। সতেরো শতকের পর্যটক টেভারনিয়ার শায়েস্তা খানের আমলে সন্দ্বীপে বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরি হতে দেখেছেন। তার বিবরণ থেকে জানা যায় সে যুগের জাহাজ শিল্পের চরম উৎকর্ষতার কথা।
No comments